1. info@mirzapurpratidin.com : admin :
  2. news@mirzapurpratidin.com : mirzapur mirzapur : mirzapur mirzapur

সায়মা ইসলামের গল্প- ইদ্রিস আলীর বিজয় দিবস উদযাপন

  • আপডেট টাইম : Friday, December 18, 2020
  • 938 বার

অনেকদিন পর বাড়ি এসেছে জাহেদ, প্রায় সাড়ে চারমাস। রাতে বাড়ি পৌঁছে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় যেতে যেতে দেড়টা বেজে গিয়েছিল। জাহানারা বেগমের পিঠাপায়েশের আয়োজনে পুরো বাড়ি ম-ম করছে। বাসি পেটে মিষ্টি খাবার খেতে পারে না জাহেদ। ইচ্ছে ছিল একটু বেলা পর্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাবে। ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ উঠে রান্নাঘরের সামনের উঠোনে আমগাছের ফাঁক গলে আসা টুকরো টুকরো রোদে গা তাপাতে তাপাতে বাড়িতে ভাঁজা মুড়ির সাথে আয়েশ করে ধোঁয়া ওঠা এককাপ চা খাবে। আহ্! অনেকদিন সকালের রোদে বসে চা খাওয়া হয় না। এরপর আম্মার সঙ্গে গল্প করতে করতে ধীরে সুস্থে পিঠাপায়েশ খেয়ে এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বের হবে এলাকা প্রদক্ষিণে। রিমিও এখন বাড়িতে। অনেকদিন সরাসরি দেখা হয় না ওর সাথে। রিমির সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ যদি পাওয়া যায়! জাহেদ আর রিমির একসাথে পথচলার স্বপ্ন দেখার গল্পটা শুরু হয়েছে বছর দেড়েক। শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী রিমি। রিমির বাবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে পাংশায় এসেছেন বছর তিনেক হলো। তিনিও বেশ পছন্দ করেন জাহেদকে ।
এমবিবিএস শেষ করে জাহেদ একাডেমিক পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে দু’বছর। এখন বিসিএস পরীক্ষার ঝক্কি ঝামেলা টপকে একজন সরকারি ক্যাডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাই জাহেদের জীবনের একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান। এটি মূলত জাহেদের আব্বার মনোবাসনা, পরিবারের একটি ছেলে উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা হলে সমাজে তার প্রভাব প্রতিপত্তি আর একটু পোক্ত হয় । পিতার স্বপ্নটাই সঞ্চারিত হয়ে ধীরে ধীরে ডালপালা ছড়িয়েছে জাহেদের মধ্যে। তাই স্বাস্থ্যসেবা পেশা ছেড়ে জাহেদের টার্গেট এখন প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডার। জাহেদের বড়ো বোনের বিয়ে হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকের পরপর। বড়ো ভাই শাহেদকে নিয়ে খুব আশা ছিল আব্বার। সে এমবিএ পড়তে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, এখন সেখানেই পাকাপোক্তভাবে খুঁটি গেড়ে বসেছে। তার আর দেশে ফেরার আর আশা নেই। এবার বিসিএস রিটেনে উত্তীর্ণ হবার পর জাহেদের এখন ভাইবার জন্য প্রস্তুতি চলছে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে যথাসাধ্য তদবিরও চলছে। মুত্তিযোদ্ধা কোঠায় চূড়ান্ত নির্বাচনের তালিকায় জাহেদের চান্স পেয়ে যাবার সম্ভাবনা উজ্জ¦ল। চাকরিতে যোগদানের করেই রিমিকে নিজের করে পাবার অধীর অপেক্ষায় দিনক্ষণ গুনছে জাহেদ।
কাল গভীর রাতে ফিরে আব্বার সাথে দেখা হয়নি। তিনি সেই ফজরের আজানের পর বের হয়ে গেছেন। যাওয়ার সময় স্ত্রীর কাছে বলে গেছেন, জাহেদ যেন আটটার মধ্যে স্টেডিয়ামে হাজির থাকে। জাহেদের আব্বা জনাব আসাদুজ্জামান খন্দকার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার। এছাড়াও এই উপজেলার আরো কিছু সংগঠনের গুরূত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত। আজ ষোলোই ডিসেম্বর, প্রোগ্রামে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর আসবার কথা আছে। বিজয় দিবস উদযাপনের সাথে সাথে স্টেডিয়ামের নবনির্মিত গ্যালারি উদ্বোধন করবেন। প্রোগ্রামের একফাঁকে ছেলেকে মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে যদি পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়, তাই প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই জাহেদকে স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকতে বলেছেন।
মায়ের ডাকাডাকিতে বহু কষ্টে পৌনে সাতটা নাগাদ আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে নামল জাহেদ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জাহেদের পুরো ছুটির আমেজটাই বরবাদ হয়ে গেল। চোখেমুখে কোনোরকম পানি ছিটিয়ে সবুজ জমিনের ওপর বুকে লাল সুতার কারুকাজ করা একখানা সিল্কের পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে সেজেগুজে বাসা থেকে বের হলো। সূর্যি মামার চিহ্ন নেই বিশ^চরাচরে। সারারাত শিশিরে ভিজে এখনো নেতিয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে চারপাশের গাছপালা। কুয়াশার মধ্যে দুই হাত দূরের জিনিসও অস্পষ্ট ধোয়াশাচ্ছন্ন । ঢাকায় ডিসেম্বরে শীতের আমেজ ঠিক টের পাওয়া যায় না। দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছেলেবেলার মতো নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার খেলা খেলতে খেলতে বাজার পর্যন্ত চলে এল জাহেদ। এখনও দোকানপাট খুলেনি। রাস্তার পাশে দু’একজন ভাঁপাপিঠার দোকানদার চুলা ধরানোর আয়োজনে ব্যস্ত। এক বন্ধ দোকানের চালার নিচে চারটে বাচ্চা নিয়ে শীতে কু্ইঁকুঁই করছে একটি সদ্য প্রসূতি কুকুর। পাশেই ছেঁড়া চটে গা মাথা ঢেকে জবুথবু বসে বাচ্চাগুলোর দিকে মায়াভরা চোখে চেয়ে আছে এক পাগলী। পায়ের শব্দে চটের ভেতর থেকে মুখটা বের করে বিরক্ত চোখে তাকাল জাহেদের দিকে, কুয়াশা ভেদ করে মুখটা চোখে পড়া মাত্র একটা অশ্লীল শব্দ বের হয়ে এল তার হলুদ দাঁেতর ফাঁক গলে। পুরুষ জাতির প্রতি তার মনোভাবের আবরণহীন বহিঃপ্রকাশ। জাহেদ দ্রুতপদে তাকে পাশ কাটিয়ে বাজার ছাড়িয়ে চৌরাস্তার মোড়ে চলে এল, ঘন কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে ছোট ছোট পতাকা হাতে লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে স্কুলের বাচ্চারা, যেন একেকজন ক্ষুদে যোদ্ধা। তাদের উচ্ছ্বাস, কলকাকলিতে শীত কেটে গিয়ে বিজয় দিবসের আমেজে জাহেদের শরীরর মন চনমন হয়ে উঠল।
বাচ্চাদের লাইনের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ঘড়ির দিকে তাকাল জাহেদ। এমনিতেই বের হতে দেরি হয়ে গেছে, আশেপাশে কোনো খালি রিকশাও নেই। অলরেডি সাতটার ওপরে বাজে। যদি প্রোগ্রাম উদ্বোধন করে এমপি সাহেব বের হয়ে যান! এই শীতেও টেনশনে জাহেদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। মোড়ের মাথায় একটা খালি রিকশা দেখে দ্রুত পদে এগিয়ে গেল জাহেদ। কাছাকাছি যেতেই পুরনো খদ্দরের চাদরে মাথা ঢাকা রিকশাওয়ালার মুখটা চিনতে পারল জাহেদ, ইদ্রিস চাচা। চাচার অবস্থা দেখে রিকসায় উঠবে না হেঁটে চলে যাবে, দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল জাহেদ।
জাহেদকে দেখে ইদ্রিস আলী উঠে দাঁড়াল, ‘কই যাইবেন বাবাজি?, ‘স্টেডিয়ামে যাব, একটু তাড়া আছে চাচা।’
‘চলেন নামাইয়া দেই।’ বিব্রত ভঙ্গিতে চাচার রিকসায় চড়ে বসল জাহেদ। ইদ্রিস আলী ‘ইনশাল্লাহ’ বলে প্যাডেলে চাপ দিলেন। কচ্ছপের গতিতে রিকসার চাকা গড়াতে শুরু করল। রিকসা টানতে টানতে চাচা বলতে শুরু করলেন ‘বুড়া মানুষ দেখলে কেউ রিকশায় উঠতে চায় না… চাচার মনে হয় হাঁপানির সমস্যা আছে, জোর করে শ^াস টেনে টেনে কথা বলছেন। ‘চাচা, আজ বিজয় দিবস, আপনি স্টেডিয়ামে যান নাই?’
‘গরিব মানুষের কোনো দিবস নাইরে বাপ। চাইল ডাইল তেল মরিচের পয়সা জোগাড়ের চিন্তায় বছরের ব্যাবাক দিনই আমাগো কাছে সমান’
রিকসায় বসে জাহেদ একটু লজ্জায় পড়ে যায়, লজ্জা কাটাতে বলে ‘আপনাদের ত্যাগেই তো এই বিজয় , এই দেশ। মুক্তিযুদ্ধের কতো গল্প শুনেছি আব্বার কাছে। আপনার কথাও বলে আব্বা, আপনি নাকি খুব সাহসী ছিলেন। সেই গল্পটা আব্বা মাঝে মাঝেই বলে, গাঁয়ে ঢুকবার পথে ছয়জন মিলিটারিসহ একটা জিপ রাস্তা থেকে বিলে ফেলে দিয়েছিলেন আপনারা। সেদিন যদি আপনি প্রতিবন্ধী সেজে রাস্তার মাঝে বসে থেকে জিপটা না থামাতেন, তবে অপারেশনটা সেদিন সাকসেসফুল হতো না। ওরা গ্রামে ঢুকে পুরো গ্রাম জ¦ালিয়ে দিত।’
ইদ্রিস আলী প্যাডেলে চাপ দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ‘ সেইসব গপ্পো ভুইলা গেছি বাজান। স্বাধীন দ্যাশে শরীর খাঁটাইয়া চাইরটা ডাইল ভাত খামু, স্বাধীনভাবে বাঁচমু, পোলামাইয়া লেখাপড়া কইরা শিক্ষিত্ হইব, সেই আশাতেই তো যুদ্ধে নামছিলাম। মানিকটা বাইঁচা থাকলে, রশিদটা মানুষ হইলে দুঃখ ছিল না। সবই কপালের ফের…
ইদ্রিস আলী সম্পর্কে জাহেদের চাচা। গ্রামে জাহেদের দাদার বাড়ি আর ইদ্রিস চাচাদের বাড়ি পাশাপাশি ভিটায়। জাহেদের আব্বা গ্রাম ছেড়েছে প্রায় দেড় যুগ। উপজেলা সদরে এক এনিমি প্রপার্টি লিজ নিয়ে সেখানে বাগান বাড়িসহ বিশাল একতলা বাড়ি করেছেন। আসাদ সাহেবের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বলতে গেলে বছরের তিন’শ ষাট দিনই তাঁর বাড়িতে কাছের, দূরের, লতাপাতায় সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের ভিড় লেগেই থাকে। চাচার বয়স আর জাহেদের বাবার বয়স প্রায় কাছাকাছি, তার মানে পঁয়ষট্টির আশেপাশে। ইদ্রিস আলীর পরনে একটা ময়লা লুঙ্গি, শার্টের ওপর সস্তার মলিন চাদর। বাংলাদেশের শ্রমজীবি মানুষদের সারা জীবনে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না, এটি একটি সাধারণ স্বাভাবিক চিত্র। ইদ্রিস চাচারও হয়নি। পরিবর্তন যা হয়েছে তার চেহারায়। জোয়ানকালের মজবুত গড়নের শরীরটা জীবনের ভারে কুঁজো হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, পাতলা সাদা চুল দাড়িতে আবৃত কোঁচকানো মুখ, চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, চোয়াল ভেঙে খাঁড়া নাকটা মাথা উঁচিয়ে এখনো তার টিকে থাকার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এখন সরকারি কত রকমের সুযোগ সুবিধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে ইদ্রিস আলী আর জাহেদের আব্বা একই কমান্ডারের অধীনে সাড়ে পাঁচ মাস যুদ্ধ করেছে। মাসের পর মাস একপাতে খেয়েছে, একসাথে খোলা আকাশের নিচে রাতের পর রাত জেগেছে, ঘুমিয়েছে, স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছে। এসব জাহেদ তার বাবার কাছেই শুনেছে। কিন্তু জাহেদ বড়ো হবার পর ইদ্রিস চাচাকে তাদের বাড়িতে দেখেছে, এরকম খুব একটা মনে পড়ে না। গ্রামের জমিজমা নিয়ে ইদ্রিস চাচাদের সঙ্গে জাহেদের আব্বার একটা ঝামেলা ছিল। নইলে জাহেদের আব্বাকে ধরে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ সরকারি কিছু সুযোগসুবিধা চাচা ভোগ করতেই পারত।
ইদ্রিস আলীর তিন মেয়ে, দুই ছেলে। ছোট মেয়ে মুক্তি, স্কুলে জাহেদের এক ক্লাস নিচে পড়ত। অনেককাল পর মুক্তির কথা মনে পড়ল জাহেদের। মুক্তির ডান পাশের ওপরের পাটিতে একটা গজ দাঁত ছিল, হাসলে খুব সুন্দর লাগত ওকে। জাহেদ যেবার ক্লাস এইটে উঠল, তখন ঝুপ করেই একদিন মুক্তির প্রেমে পড়ে গেল জাহেদ। জানুয়ারি মাসের সেই শীতের সকালটা এতদিন পরে হঠাৎ বিটিভির পুরনো নাটকের মতো ঝাপসা ভেসে উঠল জাহেদের চোখের স্ক্রিনে। সদ্য ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠেছে জাহেদ, নাকের নিচে পাতলা গোঁফের রেখা সলজ্জ উঁকি দিচ্ছে কেবল। কিন্তু নিজেকে তখন পুরোদস্তুর একজন পূরুষ ভাবতেই জাহেদের স্বস্তি। জানুয়ারি মাসের সেই কনকনে শীতের সকালে, বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে স্কুলে ঢুকছিল জাহেদ। স্কুলমাঠে বান্ধবীদের মাঝে সবুজ ইউনিফর্মের ওপরে লাল টকটকে একটা সোয়েটার পরে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল মুক্তি। নতুন সূর্যের আলোকে ম্লান করে দিয়ে মুক্তার মতো গজ দাঁতটি বের করে হাসিমুখে জাহেদের দিকে তাকাল একঝলক। আবার সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে আবার হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করতে লাগল। ঝলমলে কিশোরী মুখটাতে চোখজোড়া আটকে গিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠা জাহেদের হৃদপিন্ডে হঠাৎই ড্রাম পেটাতে লাগল কেউ যেন। সারাদিন আর কোনো ক্লাসে মন দিতে পারল না জাহেদ। আধোঘুমে আধো জাগরণে পাঁচটি রাত কাটিয়ে, ভয়ে ভয়ে প্রথম চিঠিটি লিখে তার মনের অবস্থা জানিয়েছিল মুক্তিকে। এরপর মাস পাঁচেক দৃষ্টি বিনিময়ের ফাঁকে ফাঁকে কিছু পত্র বিনিময় হলো। জাহেদই লিখত বেশি, বিনিময়ে মুক্তি লিখত খুব কম। মোটের ওপর পাঁচটি কি ছ’টি সংক্ষিপ্ত উত্তর লিখেছিল মুক্তি। ইদ্রিস চাচার ছোট ছেলে রশিদ আর জাহেদ ছিল সহপাঠি। মাস কয়েক পর বিষয়টি রশিদের চোখে ধরা পড়ে গেল । জাহেদকে কিছু বলেনি রশিদ, মুক্তিকে কষে শাসন করেছিল। ক’দিন স্কুলে এল না মুিক্ত। জাহেদের তখন রাতে ঘুম হয় না, দিনে চারিধার অন্ধকার। ক’দিন বাদে স্কুলে আসা শুরু করলেও মুক্তি আর চোখ তুলে তাকাত না জাহেদের দিকে। এইটের বছর, শেষের কয়েকটা মাস খুব খারাপ কাটল জাহেদের, বুকের মধ্যে দলা পাকানো কষ্ট আর দীর্ঘশ^াস জমে রইল। অষ্টম শ্রেণির বৃত্তিটাও মিস হয়ে গেল।
ক্লাসে বরাবর জাহেদ ছিল প্রথম সারির ছাত্র, রশিদ পেছনের সারির। কিন্তু রশিদকে বরাবর হিংসে করত জাহেদ। নরম কোমল কিশোর শরীরের জাহেদের তুলনায় রশিদ ছিল ঢের বেশি শক্তপোক্ত পূরুষ। সেকারণে মনে মনে রশিদকে কিছুটা সমীহও করত জাহেদ। রশিদ খেলাধূলায় খুব ভালো ছিল। প্রায় প্রতিবছর স্কুলচ্যাম্পিয়ন হতো সে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়, হাজার করতালির মধ্যে দু’পাটি দাঁত বের করে, নাক উঁচু করে চ্যাম্পিয়ন কাপ হাতে নিয়ে রশিদ যখন বিজয় মঞ্চের ওপর গিয়ে দাঁড়াত, তখন খুব রাগ হতো জাহেদের। ইচ্ছে হতো প্রতিবছর পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার চেয়ে একটা বছর যদি রশিদের মতো মাথা উঁচু করে বিজয় মঞ্চে দাঁড়াতে পারত! রশিদ খুব গর্ব করে বলত, একদিন জাতীয় ফুটবল দলে চান্স পেয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেবে সে। আশেপাশের দু’চার গ্রামের সকলেই জানত, সুযোগ পেলে ঠিক জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে রশিদ। এসএসসিটা তৃতীয় বিভাগে উতরে গিয়েছিল রশিদ। বিকেএসপিতে পরীক্ষাও দিয়েছিল, লিখিত পরীক্ষায় চান্স হলো না রশিদের।
তার বছরখানেক আগে একটা সরকারি দপ্তরে তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতে যোগদান করেছিল ইদ্রিস আলীর বড়ো ছেলে মানিক। সেই সরকারি চাকরির ঘুষের টাকা জোগাতেই বসতভিটাটুকু বাদে গ্রামের ফসলি জমিজমা যা ছিল বেচে দিতে হয়েছিল ইদ্রিস আলীকে। গ্রামে হুটহাট নগদ টাকায় জমির খরিদ্দার পাওয়া ভার। জাহেদের আব্বাও জলের দামে গাঁয়ে প্রতিপত্তি বাড়ানোর এমন সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। রশিদ যেবার মাধ্যমিক পাস করল, সেবারই পদ্মার লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ হলো ওর বড়ো ভাই মানিক । মানিক ভাইয়ের স্ত্রী তখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মানিক এর সঙ্গে সঙ্গে পদ্মার অথৈ পানিতে ডুবে গেল ইদ্রিস আলীর পুরো সংসার, সেই সাথে রশিদের স্বপ্ন। সংসারের হাল ধরতে মাঠে মাঠে ফুটবল নিয়ে দৌঁড় ছেড়ে ভাড়ায় অটো নিয়ে পথে নামতে হলো রশিদকে। রশিদের আর কলেজে পড়া হলো না। বিরাশি পার্সেন্ট নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পাস করে জাহেদ ঢাকা কলেজে ভর্তি হলো। রশিদের সাথে তারপর আর খুব বেশি দেখা হয়নি জাহেদের। জাহেদ কথায় কথায় রশিদের খবর জানতে চায়, ‘চাচা রশিদের খবর কী? থাকে কই? মেলা বছর দেখা হয় না ওর সাথে।
‘কই থাহে, কী করে কইতে পারি না। নেশা ভাঙ কইরা এইদিক ওইদিক পইড়া থাহে। এসময় ওসময় বাড়িত আইসা মায়ের কাছে দুই চার পয়সা যা থাহে, কাইড়া নিয়া উধাও অয়। আমি থাকলে তো বাড়ির চৌহদ্দির মইদ্যে ঢুকতে দেই না হারামজাদারে।’
জমিজমা হারিয়ে, বড়ো ছেলে হারিয়ে রশিদই ছিল ইদ্রিস চাচার শেষ ভরসা। রশিদ উচ্ছন্নে যাবার পর থেকেই তো দু’বেলা ডালভাত জোগাতে এই বয়সে টেনেহিঁচড়ে রিকশা চালাতে হচ্ছে ইদ্রিস চাচাকে। ছাত্র খারাপ হলেও নষ্ট হয়ে যাবার মতো ছেলে রশিদ ছিল না। রশিদের এমন অধঃপতনের কারণ হাতড়াতে হাতড়াতে প্রশ্ন করে জাহেদ ‘রশিদ বিয়ে করেছিল শুনছিলাম?
‘হ, করছিল, বছর পার হওনের আগেই বউটা ভাইগা গেছে। পরের মাইয়া তার দোষ দেই না। হারামজাদায় বউরে খাওন দেয় না, পরনের কাপড় দেয় না, খালি মারধোর করে…চাচা আরও কীসব বলতে থাকে একমনে। মুক্তির খবরাখবর কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও ঠোঁট চেপে চুপ হয়ে যায় জাহেদ। ক্লাস টেনে ওঠার পর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মুক্তির। মুক্তির বিয়ের খবরে খুব কষ্ট পেয়েছিল কলেজ পড়–য়া জাহেদ। মুক্তা নিশ্চই এখন বড়ো বড়ো দু’চার সন্তানের জননী, পাকা গৃহিণী। মুক্তির বর্তমান অবয়ব কেমন হতে পারে, বাতাসের গায়ে তার ছবি আঁকতে আঁকতে মন্ত্রীসাহেবের সাথে সাক্ষাতের ভাবনা বেমালুম বের হয়ে গেল জাহেদের মাথা থেকে। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি আসতে খুকখুক কাশির শব্দে জাহেদের ধ্যান ভাঙে। মাথায় আধখানা ঘোমটা টানা মুক্তির ফর্সা ভারী ভারী মুখখানা আচমকাই দৃশ্যপট থেকে মুছে গিয়ে ইদ্রিস চাচার ভাঙাচোরা মুখটা দৃশ্যমান হলো জাহদের সামনে। চাচা রিকশা থামিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে সমানে কাশছে। গলার রগগুলো ফুলে উঠেছে, মনে হচ্ছে কাশির সাথে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি। রিকশা থেকে নেমে রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে কাশতে লাগল চাচা। স্টেডিয়াম থেকে ভেসে আসছে রক্ত টগবগ করা বিজয় দিবসের উদ্ধোধনী সংগীত।
জাহেদ রিকসা থেকে নেমে গিয়ে ইদ্রিস চাচাকে ধরল ‘ চাচা খুব খারাপ লাগছে? শ^াস নিতে কষ্ট হচ্ছে? একটু পানি খাবেন?’ ইদ্রিস আলী চোখদুটো গোল গোল করে ঘোলা চোখে তাকিয়ে, বড়ো হাঁ করে শ^াস নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে জাহেদের কোলের ওপর মাথা ছেড়ে দিল। পাশের এক ছাপড়ার হোটেলের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছিল দু’ তিনজন রিকশাওয়ালা। চাচার অবস্থা দেখে তারা ছুটে এল। এদের মধ্যে একজন জাহেদের মুখ চেনা, জাহেদ তাকে বলল, চাচাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। রিকশাওয়ালা তিনজন মিলে ইদ্রিস আলীকে রিকসায় উঠিয়ে হাসপাতালে রওনা হলো। জাহেদের পকেটে শ’পাঁচেক টাকা ছিল, পরিচিত রিকশাওয়ালা ছেলেটির কাছে টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে জাহেদ বলল, ‘ তোমরা চাচাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমার একটা জরুরি কাজ আছে, কাজটা সেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আসছি।’ তাদেরকে হাসপাতালে রওনা করিয়ে দিয়ে জাহেদ চিন্তিত ভঙ্গিতে স্টেডিয়ামে ঢুকল জাহেদ। মাননীয় মন্ত্রীসাহেব আছেন, না চলে গেছেন, সেই ভাবনায় অস্থির হয়ে জাহেদ পতাকাশোভিত গাড়ির বহর খুঁজতে খুঁজতে বিজয়োৎসবের ভিড়ে মিশে গেল। রঙিন কাগজ, বেলুন, ফেস্টুন, প্যান্ডেল, স্কুলের বাচ্চাদের কলকাকলি, ড্রামের দৃপ্ত ছন্দে মুখরিত স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞাবনত সুখী সমৃদ্ধ বাংলার প্রতিচ্ছবি। এত বড়ো বড়ো লোকজনের মধ্যে আব্বাকে ডেকে ইদ্রিস চাচার অসুস্থতার খবর বলাটা সংগত হবে না বলেই মনে হলো জাহেদের।
ইদ্রিস আলীর মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেল বেলা এগারোটা নাগাদ। জাহেদের আব্বা শোক সংবাদ শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, আমার সাথে জেদ করে একটা সার্টিফিকেট পর্যন্ত নিল না নির্বোধটা। নইলে আজ সরকারি ব্যবস্থায় তার চিকিৎসা হতো, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা হতো…।’
অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জাহেদ বারোটা নাগাদ স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে এল। অসুস্থ ইদ্রিস চাচাকে ফেলে গ্রামের বাড়ির কবরস্থানে ইদ্রিস চাচার জানাজায় অনেকদিন পর রশিদের সাথে দেখা হলো জাহেদের। দাফন শেষে কবরের কাঁচা মাটি খাঁমচে ধরে মাথা নিচু করে বসে ছিল রশিদ। তার পিঠে আলতো হাত রাখতেই রশিদ মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল, ‘ হাসপাতালে নেওয়ার পর নাকি অনেকক্ষণ পড়েছিল আব্বা। ডাক্তার দেখে অক্সিজেন দিতে দিতে দেরি হয়ে গেছিল। হাসপাতালে নেওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা হলে আব্বা হয়ত আর কিছুদিন বাঁচতেন’। রশিদের কথার প্রেক্ষিতে জাহেদ কী বলবে ভেবে পায় না, নিচুস্বরে বলে ‘আজ আসি রশিদ।’
আনমনে রশিদদের বাড়ির দিকে পা চালায় জাহেদ, যদি সে নিজে ইদ্রিস চাচাকে নিয়ে যেত হাসপাতালে, হাসপাতালে তাদের পরিচিত লোকজন আছে। হয়ত সময়মতো চিকিৎসা পেত ইদ্রিস চাচা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে না হোক, স্বাধীন দেশের একজন দরিদ্র নাগরিক হিসেবে নিদেনপক্ষে এটুকু পাওনা ছিল ইদ্রিস চাচার। রশিদদের উঠোনে পাড়া প্রতিবেশিদের ভিড়। ভিড়ের মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে উঠানের এককোণে গিয়ে দাঁড়াল জাহেদ, দোচালা ঘরের চৌকাঠের সামনে চাচিকে জড়িয়ে ধরে সামলানোর চেষ্টা করছে এক মহিলা, সম্ভবত মুক্তির বড়ো বোন মনি আপা। তার পাশে দাঁড়ানো দশ বারো বছরের একটি মেয়ে, দেখতে অনেকটা সেই কিশোরী মুক্তির মতো। এমন সময় আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হলো সাদা মলিন থান পড়া এক নারী, জাহেদের দিকে চোখ পড়তে মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি স্থির হলো জাহেদের মুখের ওপর। সেই অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল জাহেদ, মুক্তি! মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে বাড়ির পথ ধরল জাহেদ। মুক্তির দৃষ্টিতে কীসের ছায়া দেখতে পেল জাহেদ? রাগ, ক্ষোভ, না ঘৃণা?

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 Mirzapurpratidin এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ভিডিও বা ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি
Site Customized By NewsTech.Com