বিশেষ প্রতিনিধিঃ
সারাদেশে চলমান লক ডাউন পরিস্থিতির মধ্যেও মির্জাপুরে অব্যাহতভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে অত্র উপজেলার প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো সাময়িকভাবে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেও নানা প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে মির্জাপুরের সকল বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহ তাদের সেবা প্রদান করায় সন্তুষ্ট এলাকার জনসাধারণ।
খাদ্য ও বস্ত্রের পরেই মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো চিকিৎসা। সম্প্রতি চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পরা অতি সংক্রমিত ভাইরাস কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপি জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পরেছে। এর বিরূপ প্রভাব পরেছে চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা করতে গিয়ে ইতিমধ্যে বহু ডাক্তার, নার্স এবং চিকিৎসাকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছে। অনেক রোগীই তাদের রোগের কথা গোপন রাখাতে ডাক্তারদের মাঝে আরো বেশি করে ছড়িয়ে পরছে এই রোগ। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বেসরকারী ক্লিনিক মালিকগণ তাদের চিকিৎসা সেবা সাময়িক বন্ধ রেখেছেন। এমন অবস্থায় সংকটে পরেছে সাধারণ রোগীরা। করোনা রোগী ব্যতীত অন্যান্য সাধারণ রোগের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকেই। এই সমস্যাকে বিবেচনায় রেখে মির্জাপুরের ক্লিনিকগুলো ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন, মির্জাপুর শাখার সকল মালিকগণ এই দূর্যোগের মধ্যেও উপজেলাব্যাপী তাদের চিরাচরিত সকল চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রেখেছেন।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মির্জাপুর মডার্ণ হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মির্জাপুরের বংশাই ডিজিটাল হাসপাতাল (প্রাঃ), নিউ আল মদিনা হাসপাতাল, মির্জাপুর জেনারেল হাসপাতাল, যমুনা জেনারেল হাসপাতাল, হালিম আধুনিক হাসপাতাল, ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিকাশ হাসপাতাল, মির্জাপুর আধুনিক হাসপাতাল সহ অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো খোলা আছে এবং যথেষ্ট রোগী সমাগম হয়েছে। এছাড়াও মির্জাপুরের পাকুল্যা এলাকায় জাহানারা ক্লিনিক, তাজ ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং গোড়াই শিল্পাঞ্চলে রংধনু ক্লিনিকেও ডাক্তার নিয়মিত রোগী দেখছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক চব্বিশ ঘন্টা জরুরী সেবা সহ মা ও শিশুর প্রসূতি সেবা এবং জেনারেল সার্জারীগুলো অব্যাহত রেখেছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
বংশাই ডিজিটাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় সেখানে জেনারেল ফিজিশিয়ান ডাঃ আব্দুল্লাহ্ আল মামুন, অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ ডাঃ পার্থ রায়, বক্ষব্যধি বিশেষজ্ঞ ডাঃ এমএইচ সিদ্দিকী তাদের স্ব স্ব চেম্বারে রোগী দেখছেন। এছাড়া মির্জাপুর জেনারেল হাসপাতালে সার্জন ডাঃ এ এস এম আনোয়ারুল কাদের সাইদ, নিউ আল মদিনা হাসপাতালে ডাঃ উম্মে সালমা, হালিম আধুনিক হাসপাতালে ডাঃ মোঃ আলামিন উজ্জল এবং মডার্ণ হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাঃ আতিকুর রহমান চৌধুরী নোমানকে চেম্বার করতে দেখা গেছে। তবে সবখানেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে রোগী দেখা হচ্ছে এবং ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীদের তাদের নিজস্ব পিপিই ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
এ সকল হাসপাতালে কোভিড-১৯ এর নমূনা সংগ্রহ কিংবা চিকিৎসা সুবিধা না থাকলেও এরকম লক্ষণযুক্ত রোগীকে কর্তব্যরত ডাক্তার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সহ সঠিক জায়গায় প্রেরণ করে থাকেন বলে তাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে।
বিভিন্ন ক্লিনিকের মালিকদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, চলমান লক ডাউন শুরু হবার পর থেকে যানবাহন চলাচল যে হারে কমে গিয়েছে, ঠিক সেই হারে রোগীর সংখ্যাও কমে গিয়েছে। তাহলে কি দেশে অন্যান্য রোগব্যাধী কমে গিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, গণপরিবহন বন্ধ থাকার দরূন অসুস্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছুতে পারছে না। তাই বলে জরুরী রোগীরা ঘরে বসে থাকে না, তারা যে কোন উপায়ে হাসপাতালে আসে। হাসপাতালে এসে যদি দেখে হাসপাতাল বন্ধ তাহলে তারা হতাশ হয়ে পরবে। সেজন্য আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রেখেছি।
সম্প্রতি মির্জাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের নমূনা সংগ্রহের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করার পর থেকে এলাকার জনসাধারণের মাঝে উদ্বিগ্নতা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া অত্র এলাকার যে কোন ক্লিনিক থেকেও সন্দেহভাজন করোনা আক্রান্তদের এখানে প্রেরণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে বংশাই ডিজিটাল হাসপাতাল (প্রাঃ) এর পরিচালক নজরুল ইসলাম জানান, দেশে করোনা রোগী ছাড়াও বিভিন্ন পদের রোগী রয়েছে। তাদের যদি চিকিৎসা দেওয়া না হয় তারা কোথায় যাবে? আমাদের নিজেদেরও কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয় আছে। তথাপি মানবিক দিক বিবেচনা করে সার্বক্ষণিক আমাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে অত্র হাসপাতালে পায়ের ব্যথার চিকিৎসা নিতে আসা রোগী জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার বাড়ি বানাইল ইউনিয়নের ভূষন্ডী গ্রামে। রাস্তায় তিন জায়গার যানবাহন বদল করে দ্বিগুন সময় নিয়ে তিনি হাসপাতালে উপস্থিত হতে সক্ষম হয়েছেন। তারপরেও হাসপাতালে ডাক্তার পেয়ে তিনি সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, এত কষ্ট করে এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসে যদি দেখতাম ডাক্তার নেই তাহলে আমার অরন্যে রোদন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
হালিম আধুনিক হাসপাতালের ডাঃ মোঃ আলামিন উজ্জল বলেন, করোনা মহামারিতে আমরা ২৪ ঘন্টা খোলা রাখছি। জ্বর, ঠান্ডা নিয়ে কোন রোগী আসলেও তাদেরকে ফেরত দেওয়া হয় না। নিজের হাসপাতালে সেবা দেওয়ার জন্য আমি দুটি জায়গায় থেকে বিনা বেতনে ছুটিতে আছি। যাতে করে এলাকাবাসি সেবা পেতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার যখন লাভ হতো তখন তো স্টাফরা বেশি বেতন নেয় নাই তাহলে এখন কেন তাদের বিপদের সময় বেতন কম দেব। আমি সার্বক্ষনিক অনকলে সেবা দিয়ে যাচ্ছি ২৪ ঘন্টা।
হালিম আধুনিক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক কাওসার হোসেন চপল বলেন, সমিতি থেকে আমাদের বলা হয়েছে প্রত্যেকটি হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড রাখার জন্য। তারই প্রেক্ষিতে আমাদের একটি আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হয়েছে। রোগী ও স্টাফদের নিরাপত্তার জন্য স্প্রে, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, সাবান ও পিপিইসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। আমাদের স্টাফদের আগে থেকেই মাসের ১ তারিখে বেতন দিয়ে থাকি এখনও সেভাবেই চলবে। করোনা হলেই যে মানুষ মারা যাবে তা নয়। একটি নতুন একটি রোগ হওয়াতে মানুষ একটু ভয় পাই। কিন্তু আমরা তাদের ভয় না পেয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকি।
বিকাশ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ গোস্বামী বলেন, এই দূর্যোগের মধ্যেও আমরা স্টাফদের বেতন দিয়ে যাচ্ছি। যাতে করে তারা কোন ধরনের বিপদের সম্মুখিন না হয়।
মির্জাপুর আধুনিক হাসপাতালের পরিচালক মোঃ আলী আজম খান বলেন, মানবিক সেবার কারনে ভূতুর্কি দিয়ে হাসপাতাল চালানো হচ্ছে।
নিউ আল মদিনা হাসপাতালের চেয়ারম্যান এস এম হান্নান বলেন, মেডিসিন ডাক্তার ফারুক ও গাইনি সার্জন ডাঃ উম্মে সালমা সার্বক্ষনিক রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা কোন ধরনের রোগী ফেরত দেয় নাই। স্বাস্থ্যসেবা মেনেই রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। জরুরী সকল প্রকার অপারেশন করা হচ্ছে নিয়মিত। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ৮০ ভাগ রোগী কম হচ্ছে। অপারেশনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
গাইনী সার্জন ডাঃ উম্মে সালমা বলেন, দেশের স্বার্থ ও মানুষের স্বার্থ আগে চিন্তা করতে হবে। এটাকেই মূখ্য মনে করে মানুষের পাশে দাড়ানো। অনেক ডাক্তার আছে তাদের চেম্বার বন্ধ করে বাড়িতে আছে। কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে রোগীরা কোথায় যাবে এ চিন্তা করেই আমি কাজ করে যাচ্ছি। যাদের করোনার লক্ষন আছে তাদের কোথায় গেলে প্রপার ট্রিটমেন্ট পাবে সে ব্যাপারে তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকি।
ডাঃ এএসএম আনোয়ারুল কাদের সাঈদ বলেন, ডাক্তাররা যদি ভয় পায় তাহলে সেবা দিবে কে। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করছি মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য। যতই দূর্যোগ আসুক না কেন আমাদের সেবা অব্যহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। আমরা মানুষের পাশে ছিলাম আছি ভবিষ্যৎতেও থাকবো।
মির্জাপুর মডার্ন হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও মির্জাপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র হাজী মোঃ মোশারফ হোসেন মনি বলেন, দেশের করোনা পরিস্থিতেও শুরু থেকেই সর্বসাধারনকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া করোনা আক্রান্ত রোগীর জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা আছে। সকল প্রকার সতর্কতা অবলম্বন করে ডাক্তার নার্স যাতে করে চিকিৎসা সেবা দিতে পারে সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আমাদের হাসপাতাল ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। এখানে সার্বক্ষনিক সার্জারি বিভাগের ডাঃ আতিকুর রহমান নোমান ও মেডিসিন বিভাগে ডাঃ সঞ্জয় কুমার মালো চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ আনিসুর রহমান ও সাধারন সম্পাদক মোঃ মোস্তফা মিয়া জানান, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট, কেমিক্যাল, ঔষধ এবং অপারেশন সরঞ্জাম আনতে পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ খরচ বেড়েছে। এছাড়াও ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট, প্যাথলজি, এক্স-রে ইত্যাদি বিভাগ চালু রাখতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে। তথাপি আমরা বর্তমান দূর্যোগের কথা বিবেচনা করে পূর্ব নির্ধারিত মূল্যেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তবে এভাবে কতদিন চালিয়ে যাওয়া যাবে সেই প্রশ্ন এখন সকল মালিকদের মনে উদয় হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কিয়দাংশ যদি বেসরকারী হাসপাতাল ক্লিনিকের জন্য বরাদ্দ দেন তবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।
অপরদিকে অন্যান্য হাসপাতালের পাশাপাশি সিটি ডেন্টাল কেয়ার ও প্রাচী ডেন্টাল কেয়ারসহ অন্যান্য ক্লিনিকগুলো সার্বক্ষণিক তাদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
Leave a Reply