বিশেষ প্রতিবেদক : লকডাউন শিথিল করার পর মাস্ক পড়ায় অনীহা দেখা দিয়েছে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে। কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের শর্ত ঠিকভাবে মানছে না কেউই। ৫ দিন না যেতেই যেন সব শর্ত ভুলতে বসেছে সবাই। রাজধানীর বড় শপিং মল ও সুপারশপগুলোতে কিছুটা মানার চেষ্টা চললেও ছোট মার্কেট ও বাজারে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছে না কেউই। কাঁচাবাজারগুলো স্বাভাবিক সময়ের মতোই জমজমাট। শরীর ঘেঁষে ভিড় করে কেনাকাটা করছে ক্রেতারা। ক্রেতার মাস্ক মুখে থাকলেও বিক্রেতার মাস্ক মিলছে থুতনিতে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে সরকারের প্রায় সব কিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহবান জানানো হয়েছে। তারা বলছে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে কিছু বিষয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা প্রয়োজন, এটা ঠিক। কিন্তু সব কিছু খুলে দেওয়াটা সামনের দিনে বড় ঝুঁকি তৈরি করবে।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্ক, গুলশান-১ ডিএনসিসি মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি বড় শপিং মলে মাস্ক ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মাপা হচ্ছে তাপমাত্রাও। দোকানের ভেতর ক্রেতাদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে রাজধানীর নিউ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেটসহ ছোট মার্কেটগুলোর প্রবেশপথে জীবাণুনাশক টানেল নেই। ভেতরে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই, অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। কিছু বিক্রয়কর্মীর মাস্ক ছিল থুতনিতে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, আগের মতো মাঠে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হোক। তাহলে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি লকডাউন আরো এক থেকে দুই সপ্তাহ বাড়ানো হলে বেশি সুফল পাওয়া যেত বলে মনে করছে। এ ছাড়া ন্যূনতম সভা-সমাবেশ, সামাজিক অনুষ্ঠান, পর্যটন-বিনোদনকেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি আরো কিছুদিন বন্ধ রাখা, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফেটেরিয়ায় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা না রেখে শুধু বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া, সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলসহ বেশ কিছু বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে ওই কমিটি।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, করোনার সংক্রমণ গত বছরও এই সময় বেশি ছিল। পরে আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এ বছরও আমরা দেখছি। জুন-জুলাই মাসে সংক্রমণ অত্যন্ত বেশি ছিল। আগস্টে এসে তা কমতে শুরু করেছে। সংক্রমণ হার ধীরে ধীরে কমে আসবে। এবছর মানুষকে টিকা দেয়া হচ্ছে। টিকার আওতায় মানুষকে আরও বেশি আনতে হবে। এ ছাড়া মানুষ যদি সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানে তাহলে সংক্রমণ কমবে দ্রুতই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেছেন, করোনার কারণে দেশে দীর্ঘদিন লকডাউন ছিল। এর প্রভাবে করোনার সংক্রমণ আস্তে আস্তে কমে আসছে। আশা করি আগস্টের শেষে আরও সংক্রমণের হার কমবে। মানুষ যদি স্বাস্থ্যবিধি মানে এবং আরও বেশি মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যায় তাহলে সংক্রমণ দ্রুত কমবে। তবে সংক্রমণ যদি ৩ সপ্তাহ শূন্যের পর্যায়ে থাকে তখন বলা যাবে করোনা নাই।
গণপরিবহনে মাস্ক পরায় অনীহা : গত ১১ আগস্ট থেকে সারাদেশে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। স্বাভাবিক সময়ের ভাড়ায় ফিরে এসেছে গণপরিবহন। তবে পরিবহন চললেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ‘দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করা যাবে না’ এ মর্মে নির্দেশনা দিয়েছিল। বিআরটিএর সে নির্দেশনা এখন শুধু কাগজে-কলমে। প্রায় প্রতিটি পরিবহনেই নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত যাত্রী। ভাড়া কম না নিলেও দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া বন্ধ হয়নি।
অন্যদিকে গণপরিবহনে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি। বাসগুলোতে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হচ্ছে। আবার অধিকাংশ যাত্রী মাস্ক পরলেও বেশিরভাগই মাস্ক ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি মানছেন না। তারা থুতনিতে রাখছেন মাস্ক, কেউ কেউ নাক বাদ দিয়ে শুধু মুখ ঢেকে রেখেছেন। যাত্রীদের একটি অংশ আবার মাস্কবিহীন চলাচল করছেন।
সোমবার রাজধানীর মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, পল্টন, মালিবাগ, রামপুরা, বাসাবো ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। অনেক জায়গায় দেখা যায়, বাসচালক মাস্ক ব্যবহার করলেও তার সহকারীর মাস্ক নেই। যাত্রীদের অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করলেও সেগুলো রেখেছেন শুধু থুতনিতে।
তুরাগ পরিবহনের হেলপার সুমন বলেন, ‘মাস্ক পরলে যাত্রীরা কথা শুনতে পান না। আমরা সারাক্ষণ কথা বলি, তাই মাস্ক দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখা সম্ভব হয় না।’
রাইদা পরিবহনের হেলপার শফিক মাস্ক ছাড়াই যাত্রী সেবায় নিয়োজিত। তিনি বলেন, ‘মাস্ক পরা ভালো তবে এতে অসুবিধাও আছে। আমার কথা যাত্রীরা শুনতে পান না। তাছাড়া অনেক যাত্রীও আর মাস্ক পরছেন না।’
তবে যাত্রীদের একটা বড় অংশই মাস্ক ব্যবহার করছেন। এ বিষয়ে কথা হয় নূর-এ মক্কা পরিবহনের যাত্রী সুলাইমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতি এখননো ভালো অবস্থায় আসেনি। এ অবস্থায় আমরা সচেতন না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।’
মাস্ক ব্যবহারে অনীহা এমন যাত্রীদের সংখ্যাও কম না। তাদের একজন জয়নাল আবেদিন। রাইদা পরিবহনযোগে কমলাপুর যাবেন। তিনি বলেন, ‘এখন পরিবেশ ভালো দেখেই সরকার সব চালু করেছে। তবে মাস্ক পরলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার মতো অবস্থা তৈরি হয়। তবে ওইটা পরতে পারলে ভালো।’
অপরদিকে রাস্তায় চলাচলরত পথচারীদের বেশিরভাগই মাস্ক ছাড়া দেখা গেছে। একই অবস্থা তৈরি হয়েছে পাড়া-মহল্লায় বসা অস্থায়ী ছোট ছোট বাজারগুলোতেও। সেখানেও নেই স্বাস্থ্যবিধি, মাস্ক ছাড়াই নিত্যপণ্য কেনাকাটা করছেন সবাই।
Leave a Reply