1. info@mirzapurpratidin.com : admin :
  2. news@mirzapurpratidin.com : mirzapur mirzapur : mirzapur mirzapur
একটি অতি সাধারণ অপমৃত্যুর গল্প- সায়মা ইসলাম - mirzapurpratidin.com
শিরোনামঃ
মির্জাপুরে সুরে সুরে দর্শক মাতালেন সুর সম্রাট মশিউর রহমান মির্জাপুরে রাস্তা নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করলেন পৌর প্রশাসক মির্জাপুরে আন্দোলনে হিমেলের দুচোখ অন্ধের মামলায় ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার আল্লাহর গজব পড়েছে আ.লীগের উপর: সাবেক এমপি কালাম মির্জাপুরে স্কাউটস নির্বাচনে ভোটে সহিনুর, ফরহাদ ও সেলিম বিজয়ী মির্জাপুরে ছাত্র শিবিরের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন মির্জাপুরে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৮ শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা মির্জাপুরে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করলেন ইউএনও মির্জাপুরে আ.লীগের উন্নয়ন কাজের ফলক ভাঙার চেষ্টায় গণপিটুনি মির্জাপুরে আধিপত্য কেন্দ্রিক হামলা-পাল্টা হামলায় আতঙ্ক

একটি অতি সাধারণ অপমৃত্যুর গল্প- সায়মা ইসলাম

  • আপডেট টাইম : Saturday, October 31, 2020
  • 1060 বার

আম্মা হাসপাতাল থেকে ফিরে ওজু করে সেই যে এশার নামাজে বসেছেন, আর ওঠার খবর নেই। সেই সকাল থেকে ভাবিকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ে আমি আর আম্মা আজ সারাদিন প্রায় না খেয়ে আছি। ভাবির আব্বা আম্মা আসার পর হাসপাতালে তাদের রেখে আমরা বাসায় ফিরেছি সন্ধ্যার পর। আম্মা বাসায় ফিরেই ওজু করে নামাজে বসেছে। টেবিলে খাবার দিয়ে আাম্মাকে ডাকতে এসে বসে আছি দশ মিনিটের ওপর, আম্মা মোনাজাতে বসে গুনগুন করে কাঁদছে তো কাঁদছেই। একমাত্র ছেলের ঔরসে একটি সুস্থ স্বাভাবিক সন্তানের আশায় গতকাল থেকে আম্মা দোয়া ইউনুস খতম শুরু করেছেন। ভাবির এবারের বাচ্চাটি যাতে সহি সালামতে ভূমিষ্ঠ হয়, সে প্রার্থনায় আম্মা প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর দোয়াদরুদ শেষে দীর্ঘ সময় আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বসে থাকেন।
বিছানায় বসে আমার চার বছরের মেয়ে তন্বী আম্মার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করে ‘আম্মু, নানু কেন নামাজ পড়তে বসে সব সময় কাঁদে?
‘নানু আমাদের জন্য দোয়া করছে মা।’ তন্বীর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি ওর শ্যামলা মুখটার দিকে চেয়ে থাকি। আমরা স্বামী স্ত্রী দুজনই ফরসা, কিন্তু মেয়েটার গায়ের রং হয়েছে শ্যামলা। তন্বীর মুখের আদলে বরাবরই জবার মুখের একটা ছাপ খুঁজে পাই আমি। হয়ত এটা শুধুই আমার মনের ভুল।
আম্মার কান্না দেখে আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকে। মনে হয় জবার সেই ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া মুখটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সেই বিভৎস মুখটা মন থেকে তাড়িয়ে জবার হাস্যোজ্জ¦ল মুখটা প্রাণপণে মনে করতে চাই আমি, কিছুতেই মনে করতে পারি না।
আমার একমাত্র ভাই প্রকৌশলী রিজওয়ানুল হক রনি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ভাবি এবার রাজশাহী ইউনিভার্সির্টিতে অনার্স শেষ পর্বের ছাত্রী। এই ডিসেম্বরে বিয়ের চার বছর পূর্ণ হলো ওদের। ভাইয়া বছরে দু’বার দেশে এসে সপ্তাহ দুয়েক কাটিয়ে যায়। ভাবিও গতবছর একবার মাসখানেকের জন্য অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ঘুরে এসেছে। অনার্স শেষ হওয়ার আগে ভাবির বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে ছিল না মোটেও। পরীক্ষা শেষ করেই অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেবার জন্য তল্পিতল্পা গুটিয়ে রেডি হয়েছিল। কিন্তু আমার আব্বার পরপর দু’বার স্ট্রোকে বাঁ পাশটা অচল বছর খানেক। নাতি নাতনির মুখ দেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চান। শ্বশুরের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতেই ভাবি এবার তৃতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা। এর আগের দুইবার যথাক্রমে দুইমাস ও সাড়ে তিন চার মাসের মাথায় ভাবির গর্ভপাত হয়ে যায়। দ্বিতীয় বার ভাবির অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল, ক্লিনিকে ভর্তি থাকতে হয়েছিল তিনদিন।
ভাবির ডাক নাম যুথী; বেশ শান্তশিষ্ট সরল মনের মেয়ে, দেখতে চমৎকার। আমার সাথে খুব বন্ধুসুলভ স¤পর্ক। আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোটো বলে আম্মার আড়ালে ভাবিকে আমি নাম ধরেই ডাকি। বয়সে ছোটো হলেও বড়ো ভাইয়ের বউকে নাম ধরে ডাকা আম্মা একদম পছন্দ করেন না।
আম্মার ছেলের বউটা হয়েছে একদম আম্মার মনের মতো। দেখতে শুনতে, লেখাপড়ায়, এমন কি পারিবারিক স্ট্যাটাস সবদিক থেকে আমার ভাই সুযোগ্য বউ পেয়েছে, মাশাল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আম্মার একমাত্র হীরের টুকরো ছেলের বউ নিয়ে তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন। এবারও করবেন, ইনশাল্লাহ।
ডাক্তার ভাবিকে স¤পূর্ণ বেডরেস্টে দিয়েছেন। কনসিভ করার খবর জানার পরই ছেলের বউকে দেখেশুনে রাখতে আম্মা কালবিলম্ব না করে ভাবিকে জোর করে হল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছে। সামনেই ভাবির অনার্স ফাইনাল, সে হল ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না। আম্মা বলেছে, দরকার হলে এ বছর পরীক্ষা ড্রপ দিতে হবে। এবার আর আগের দু’বারের মতো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আম্মা ভাবিকে পারতপক্ষে বিছানা থেকেও নামতে দেয় না। ভাবির আটাশ সপ্তাহ পার হলো গত সপ্তাহে। আম্মা বেশ আয়োজন করে ভাবির সাতোশা দিলেন।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে তন্বীর স্কুল ছুটি। আমিও সংসার থেকে দিন পনেরো ছুটি নিয়ে একসপ্তাহ হলো বাপের বাড়ি এসেছি। এ বাড়িতে মাত্র তিনজন মানুষ, আব্বা, আম্মা আর আম্মার সহকারি হেলেনা খালা। তিনজন বয়স্ক মানুষের মাঝে ভাবির একা একা লাগে, তাই আমি আসাতে আব্বা-আম্মার চেয়ে ভাবিই বেশি খুশি। আম্মার নজরদারিতে ভাবি খুব হাঁপিয়েও উঠেছে মনে হয়। এর আগে ভাবিকে এতটা সময় কাছে পাইনি আমরা, সে থাকে হলে। তন্বীর সাথেও তার মামির খুব ভাব। হাসি, খেলায়, গল্পগুজবে আমাদের তিনজনের চমৎকার সময় কাটছিল। এবার নানাবাড়ি এসে মামিকে কাছে পেয়ে তন্বী খুব খুশি।
সকালে ভাবিকে নাস্তার জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি, ভাবি চোখ মুখ শুকনো করে বিছানায় হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। ভালো করে জিজ্ঞেস করতে ভাবি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ‘সাররাত পেটে হালকা হালকা ব্যাথা করছিল, সকাল থেকে পানি ভাঙছে একটু একটু।’ ভাবির গাল বেয়ে টপটপ পানির ফোঁটা পড়ছে । আমি ভাবির হাতে হাত রেখে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম ‘এত ভয় পাচ্ছো কেন? ডাক্তারের সাথে কথা বলি, দেখি কী বলেন।’
আম্মাকে জানানোর সাথে সাথে আম্মা অস্থির হয়ে পড়লেন। এগারোটার দিকে ভাবিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার চেকআপ করে বললেন হসপিটালে ভর্তি হতে। সাথে সাথে ভাবিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। বেডে শুয়ে ভাবি খুব কান্নাকাটি করছিল। সেই সাথে আম্মাও আঁচলে চোখের পানি মুছছে অবিরত। আম্মাকে ডেকে কেবিনের বাইরে নিয়ে আসলাম, ‘আম্মা তুমি এমন করলে তো ভাবি আরও ভয় পাবে তাই না?
আম্মা আমার দিকে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ মুছতে লাগল। আম্মার দৃষ্টিতে ঘন আতঙ্কের ছায়া। দশ বছর আগে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া আমার প্রিয় বান্ধবী জবা আমাকে একলা অবসরে পেলেই দু’চোখে এসে জুড়ে বসে, শত চেষ্টা করেও আমি ওকে দূর করতে পারি না আমি। আজ আম্মার চোখেও সেই মুখের ¯পষ্ট ছায়া দেখতে পেলাম আমি।
আমার আব্বা খন্দকার বদরুল আলম পুলিশের চাকরি করতেন। প্রমোশন পেয়ে ২০০৮ সালের মে মাসে আব্বা রাজাবাড়ি থানার ওসি হয়ে এলেন। আব্বার সরকারি চাকুরির সুবাদে বছরের মাঝখানে রাজাবাড়ি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে ভর্তি হলাম। জবার সাথে তখন থেকেই বন্ধুত্ব। জবা চঞ্চল প্রকৃতির, শ্যামবর্ণের মিষ্টি একটা মেয়ে। জবার বাবার হকার্স মার্কেটে লুঙ্গি গামছার ছোটো দোকান। নয়াপাড়ায় একগলির ভেতর জবাদের টিনশেডের ভাড়া বাসা। ওরা তিনবোন, জবা সবার বড়ো।
শহরের মেইন রোডে চারতলা এক বিল্ডিং এর তিনতলার এক ফ্ল্যাটে উঠলাম আমরা। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে জবার স্কুলে যাতায়াত। জবা প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় আমায় ডেকে নিয়ে যায়, ফেরার সময় একসাথে ফিরি। আব্বার ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরার সময়ের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমার আম্মা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করেন, স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা।
আমরা দু’ভাই বোন। ভাইয়া সেবার উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে, তুখোড় ছাত্র। বরাবর ভাইয়াই আমার অংক ইংরেজি দেখিয়ে দেয়। জবাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। প্রাইভেট টিউটর রেখে পড়ার সাধ্য নেই। ভাইয়া বলল, চাইলে জবাও আমার সাথে পড়তে পারে। সপ্তাহের চারদিন স্কুল থেকে ফেরার পর ভাইয়ার কাছে আমরা পড়ি। পড়া শেষে গল্পগুজব করে সন্ধ্যার আগে জবা বাসায় চলে যায়।
পড়াশোনায় জবার খুব আগ্রহ। ফাইনাল পরীক্ষার আগের পাঁচমাস ভাইয়ার কাছে পড়ে ক্লাস টেনে জবা তৃতীয় হলো। আমার হলো একুশ। জবার বাবা মা ভারি খুশি জবার রেজাল্টে। সামনে আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষার হ্যাপা চুকিয়ে ভাইয়ার অনেকটা অলস সময় কাটছে তখন। জবা মনোযোগী ছাত্রী, ভাইয়ারও জবাকে নিয়ে প্রচ- আগ্রহ। অংক না বুঝলে ভাইয়া হয়তো জবার মাথায় একটা চাটি মারে, জবা ঠোঁট ফুলায়। ভাইয়া জবার রাগ ভাঙায়। দুজনের মধ্যকার টক ঝাল স¤পর্কে দারুণ মজা পাই আমি। জবাকে ভাইয়ার আড়ালে ক্ষ্যাপাই ‘কীরে আমার ভাবি হওয়ার ইচ্ছে খুব না? আমার কথায় জবা রাগে ফেটে পড়ে, আবার লজ্জায় লাল হয়।
ভাইয়ার টার্গেট ছিল বুয়েট, চান্স হলো রুয়েট সিইইতে। ভাইয়ার এক কথা, প্রাইভেটে হলেও ঢাকায় পড়বে, উত্তরবঙ্গে পড়বে না। আব্বা বুঝিয়েসুঝিয়ে ভর্তি করলেন, বললেন, আপাতত ভর্তি হয়ে দেশের বাইরে স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করতে।
আম্মার এমনিতে ভাইয়ার কাছে জবার পড়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল না। কিন্তু ভাইয়ার বুয়েটে চান্স না পাওয়ায় আম্মা কেন যেন জবার ওপর বিরূপ হলেন। জবা সেটা আঁচ করতে পেরে আমাদের বাসায় আসা প্রায় ছেড়ে দিলো। আমি পড়ার কথা বলে ওকে জোর করে ধরে নিয়ে আসতাম। আম্মা স্কুল থেকে ফেরার আগেই পড়া শেষ করে জবা চলে যেত। রাজশাহীতে ভর্তি হওয়ার পরও ভাইয়া ঘনঘন বাসায় চলে আসত। প্রায় প্রতি সপ্তাহে, হয়ত জবার জন্য।
সেবার শীতের ছুটিতে ভাইয়া বাসায় এসেছে দু’সপ্তাহের জন্য। আম্মা পিঠা বানানোর আয়াজন করছিলেন সেদিন, সন্ধ্যায় খবর এল নানীর শরীর খুব খারাপ। ভাইয়ার কী সব কাগজপত্র গোছানোর আছে, তাই যেতে পারবে না। পরদিন ভোরে আম্মা আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি রওনা হলো।
তিনদিন পর ফিরে স্কুলে গিয়ে জবার দেখা নেই। বান্ধবীদের কাছে শুনলাম জবাও তিনদিন স্কুলে আসে না। স্কুল শেষে জবার খোঁজ নিতে ওদের বাড়িতে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি, শেষ বিকেলে জবা বিছানায় শুয়ে। আমি পাশে গিয়ে বসতে শোয়া থেকে উঠে মাথা নিচু করে বসে রইল। জবা খুব পরিপাটি স্বভাবের, সেদিন দেখতে কেমন উশকোখুশকো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ওর ওপর দিয়ে বিশাল কোনো ঝড় বয়ে গেছে।
‘স্কুলে যাচ্ছিস না যে, কী হয়েছে তোর?’
‘কিছু না।’ আমার দিকে না তাকিয়ে জবা চুন খসে পড়া দেয়ালের দিকে চেয়ে রইল। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম শরীরটা গরম গরম। আমি বললাম ‘সামান্য গা গরম হয়েছে, তাই এ অবস্থা?’ মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগল জবা। চড়–ই পাখির মতো ছটফটে জবার দু’দিনের মধ্যে কী এমন হলো বুঝতে পারলাম না। খালাম্মা বললেন, গত পরশু স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে শুয়ে আছে। কাল রাত থেকে জ্বর।
জবা তো তিনদিন হলো স্কুলে যায় না। খালাম্মাকে আমি কিছু বলার আগেই জবা আমার হাত চেপে ধরল। আমি চুপ করে গেলাম। ফিরে আসার আগে খালাম্মার আড়ালে জিজ্ঞেস করলাম। ‘কী ব্যাপার? না বলে কোথাও গিয়েছিলি? খালাম্মা মেরেছে তোকে?’
জবা ডানে বামে মাথা নাড়ালো, তারপর কোনোমতে ফিসফিস করে বলল ‘তোদের বাসায় গিয়েছিলাম।’
‘তারপর সারাদিন কোথায় ছিলি?’
‘কোথাও না।’ জবার গলা দিয়ে স্বর ফুটছিল না। আমি বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,‘সারাদিন আমাদের বাসায় ছিলি?’।
‘স্কুল যাওয়ার পথে তোকে ডাকতে গিয়েছিলাম। দেখি তুই নেই। রনি ভাই খুব করে বলল, দশ মিনিট বসতে, কথা বলবে। আমি বসলাম। তারপর রনি ভাই আটকে দিলো, পাঁচটায় স্কুল ছুটির সময় বাসায় এসেছি। আম্মা জানে না, আমি পরশুদিন স্কুলে যাইনি।’
‘সারাদিন আমাদের বাসায় ছিলি? ভাইয়াকে রান্না করে খাওয়ালি নাকি? এখনই প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছিস?’ আমি হাসতে হাসতে জবার হাতে জোর চিমটি কেটে নখের দাগ বসিয়ে দিলাম।
জবা আমার দিকে কেমন অপরাধী চোখে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল ‘ রনি ভাইকে কিছু বলিস না, প্লিজ। রনি ভাই এ কথা কাউকে বলতে মানা করেছে, তোকেও না।’ জবার হাবেভাবে আমার কেমন খটকা লাগে। জবা আমাদের বাসায় গিয়েছিল, ভাইয়া কেন এ কথাটা আমাকে জানাতে নিষেধ করবে?
জানুয়ারি মাসের চার তারিখে ভাইয়া অস্ট্রেলিয়া চলে গেলো। ফেব্রুয়ারির শেষে আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। ভেবেছিলাম পরীক্ষা শেষে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ঘুরব, বেড়াব, আনন্দ করব। কিন্তু জবার কোন সাড়াশব্দ নেই। বাসা থেকেও বের হয় না, আমাদের বাড়িও আসে না। জবার পরীক্ষাও বিশেষ ভালো হয়নি। ভাবলাম জবার হয়তো ভাইয়ার জন্যও মনটা খারাপ। সারাদিন বান্ধবীদের সাথে মজা করব বলে জবাকে ধরে নিয়ে আসতে ওর বাড়ি গিয়ে দেখি জবা এ ক’দিনে শুকিয়ে প্রায় আধমরা, গাল ভেঙে চোখের নিচে কালি। ওদের বাড়ির পরিবেশ কেমন থমথমে। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবা শুধু নিঃশব্দে কাঁদে। খালাম্মা আমাকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন, গলারস্বর বিষণœ ‘রীমু তুমি তো আমার মেয়ের মতো। তোমাকে খুব বিশ্বাস করি। সত্যি করে বলো তো, জবার কার সাথে স¤পর্ক?’
‘কেন খালাম্মা, কিছু হয়েছে?’ খালাম্মার মুখ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। জবার আম্মা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন ‘জবার পেটে তো বাচ্চা। ওর আব্বাকে এখনো কিছু বলি নাই। উনি জানলে তো ওকে মেরেই ফেলবেন।’
আমি বিষ্ময়ে হাঁ হয়ে জবার আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কী বলছেন, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি না। আমার অতি সুসভ্য শান্তশিষ্ট স্কলার ভাইয়ের কথা আমি উনাকে কী করে বলি! জবার কাছে গিয়ে শুধু নির্বাক বসে রইলাম। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল ‘আমি এখন কী করব রীমু? আমাকে তুই বাঁচা। রনি ভাই বলেছিল, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এলে আমাদের বিয়ে হবে। রনি ভাইকে বল কিছু একটা করতে, নইলে আমি মরে যাব। রীমু, তুই রনি ভাইয়ের সাথে একবার আমায় কথা বলিয়ে দে, আমার কথা শুনলেই রনি ভাই দেশে চলে আসবে…
জবাকে একবার ভাইয়ার সাথে কথা বলিয়ে দিলাম। ভাইয়া জবাকে বলল, এখন তো কোনোভাবেই দেশে আসা সম্ভব নয়। এখন আব্বা আম্মার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। এরপরে ভাইয়া জবার সাথে আর কথা বলতে রাজিই হলো না।
আম্মার কাছে ভয়ে ভয়ে কথাটা একদিন সাহস করে তুললাম। ভাইয়ার সাথে জবার স¤পর্কের কথা বলতেই, আম্মা আমার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন। বললেন, ভাইয়ার কানে যেন এসব কথা না পৌঁছায়। আমি যেন এ ব্যাপারে আর টু শব্দটিও না করি। উলটাপালটা কিছু বলে ফেললে ভাইয়ার ভবিষ্যত একেবারে শেষ। আমি যেন ভুলেও মুখ না খুলি। আমিও আমার একমাত্র প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের উজ্জ¦ল ভবিষ্যতের চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়লাম।
জবার বাবা তিনদিন আসলেন আমাদের বাসায়, আব্বার সাথে কথা বলতে। সাথে জবার এক চাচা। আব্বা আম্মা বিষয়টা পুরো অস্বীকার করলেন। জবার চাচা আব্বাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন খুব ‘দ্যাখেন দারোগা সাহেব, মেয়েটার বয়স কেবল ষোলো পার হয়েছে। বিষয়টা মহল্লার কাউকে জানাতে চাই না, মান সম্মানের প্রশ্ন। আপনি একজন সম্মানিত মানুষ। আপনার ছেলের সাথে জবার বিয়েটা দিয়ে দিলে আপনারও মান বাঁচে, মেয়েটারও বাঁচার একটা পথ থাকে।
আব্বা তার স্বভাব সুলভ পুলিশি কন্ঠে বললেন ‘কাউকে জানানো না জানানো আপনাদের ব্যাপার। আমার ছেলে দেশে নেই। লেখাপড়া ছাড়া ও কোনোদিন কোনোদিকে তাকায়নি। ওর বিরুদ্ধে এধরনের অভিযোগ আনলে আপনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে বাধ্য হবো।’
জবার বাবা আব্বার দু’হাত আঁকড়ে ধরে পড়ল ‘মেয়েটাকে নিয়ে এখন কোথায় যাব, কী করব ভাই সাহেব, আপনে বলেন। গলা টিপে মেরে ফেলতেও পারতেছি না। আমার আরো দুইটা মেয়ে আছে ভাইসাব, ওদেরও তো বিয়েশাদি দিতে হবে…
‘এ্যাবরসন করিয়ে ফেলুন। রনি ফিরলে বিষয়টা দেখব।’ আব্বার একরোখা কন্ঠে জবার আব্বা চোখ মুছতে মুছতে বলল ‘তিনমাস পার হয়ে গেছে। এখন এসব করলে মেয়েটা বাঁচে কি না সন্দেহ।’
‘ভালো ক্লিনিকে ভর্তি করুন। খরচাপাতি যা লাগে আমি দেবো, চিন্তা করবেন না। ছেলেটাকে এখন এসব বিষয়ে জড়াতে চাই না।’
জবার আব্বা মান সম্মানের ভয়ে এলাকায় কারো কাছে বিষয়টা প্রকাশ করলেন না। আব্বার সাথে এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, দলীয় নেতাকর্মী সকলের দহরম মহরম। সবাই জানে, আমাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কথা কেউ কানে তুলবে না। জবার আম্মা এসে দুইদিন আম্মার পায়ে পড়ল। ওসি সাহেবের চেয়েও কঠোর স্বর আম্মার ‘আপনার মেয়ে কার সাথে কী করেছে, সে দায় আমার ছেলে কেন নেবে? এটা খুব অন্যায় আচরণ আপনাদের।’
‘রীমুর কাছে শুনেন আপা। আপনাদের বাসা ছাড়া জবা কোথাও যায় না। কারো সাথে মেশে না। আপনার ছেলে রনির সাথেই ওর স¤পর্ক ছিল। রীমুর সাথে পড়ে বলে আমি আপনাদের বাসায় যাওয়া-আসা নিয়ে কোনোদিন সন্দেহ করি নাই…জবার আম্মা কাঁদতে থাকে। ‘আপনার মেয়ের সাথে এরকম হলে কী করতেন আপা?’
‘আমার ছেলে মেয়ের চরিত্র এরকম নয়।’ আম্মা দৃঢ় কন্ঠে বললেন।
‘আপা, রীমুকে একবার ডাকেন। ওর কাছেই জিজ্ঞেস করেন। জবাকে তো ও চেনে। ওই আসল সত্যটা বলতে পারবে।’ আম্মা আমাকে ডাকলে জবার আম্মার সামনে গিয়ে আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম।
জবাকে দূরের কোনো ক্লিনিকে এ্যাবরসন করতে নেওয়া হয়েছিল। চারমাস হয়ে গিয়েছিল, এ্যাবরসনের দু’দিন পরও জবার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। তিনদিনের দিন জবাকে আনা হলো বাড়িতে। খবর পেয়ে আম্মাকে না জানিয়েই বান্ধবীদের সাথে জবাদের বাড়িতে গেলাম ।
বাড়ির উঠানে জবার প্রিয় বরই গাছের নিচে একটা খাটিয়ায় জবাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বারান্দার সামনে একটা চেয়ারে বসে সেদিকে চেয়ে ওর আব্বা পাথর হয়ে বসে আছেন। ঘরের ভেতর থেকে জবার আম্মা, দুই বোনের আর্তনাদ ভেসে আসছে। জবার আম্মা বুক চাপড়ে চাপড়ে হাহাকার করছেন আর আল্লাহ্র কাছে বিচার চাইছেন। পাড়া প্রতিবেশি সবাই লাইন ধরে এসে দেখছে, কী হয়েছিল ফিসফাস আলোচনায় বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
আমি উঠানে কিছুটা দূরে মুখে ওড়না দিয়ে বান্ধবীদের পেছনে দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। পাক্কা একমাস পর জবার সাথে দেখা আমার। দেখা হলে জবা সব সময় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরত আমাকে। আজ তো ও ছুটে আসতে পারছে না। আমি কেন একটু কাছে গিয়ে শেষবারের তো ছুঁয়ে দেখতে পারছি না ওকে, ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারছি না। সাদা ধবধবে কাফনের কাপড়টা সরতেই মূহুর্তের জন্য চোখ পড়েছিল মুখটায়। ফুলে ফেঁপে ওঠা পাংশুবর্ণ মুখটাকে কিছুতেই জবা বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। ভয়ে আমার পুরো শরীর হৃৎপি-সহ কাঁপছিল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে পালিয়ে এলাম।
আমার গলায় গলায় ঘুরে বেড়াত যে জবা, কারণে অকারণে ছটফট করত যে জবা, রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারত না যে জবা, এত জীবনীশক্তি যে জবার, এত তাড়াতাড়ি কী করে ফুরিয়ে যেতে পারে! এত সহজেই হেরে গেল জবা? কার কাছে হেরে গেল জবার সরলতা? শুধু ভাইয়ার প্রবঞ্চনায় ? না আমাদের হঠকারিতায়? জবা কী আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে? জবার সেই উচ্ছল শ্যামলাকান্তি মিষ্টি মুখের বদলে রক্তহীন সাদা ফ্যাকাশে ফুলেফেঁপে ওঠা ট্যাপট্যাপে মুখটা চিরদিনের জন্য আমার একলা সময়ের সাথি হয়ে গেল।
তারপর থেকে চোখ বন্ধ করলেই জবার বিভৎস মুখটা আমার দু’চোখের পর্দায় ভেসে উঠে, বমি পায়। আমি ঘুমাতে পারি না। একলা থাকলেই জবা হাজির হয় আমার সামনে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁদতে থাকি। আমার প্রিয় জবা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শত্রু হয়ে দাঁড়াল। পরের মাসেই আমরা ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় এসে আমাকে মানসিক ডাক্তার দেখানো হলো। এই সমস্যার জন্যই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো। বছর খানেক পরেই তন্বী এল আমার কোলে, আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে।
ফ্লুইড কমে যাওয়ার কারণে পরের দিন ভাবির সিজার করার সিদ্ধান্ত নিলেন ডাক্তার। আধঘন্টা আগে ভাবিকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে । বিকেল সাড়ে পাঁচটায় একজন নার্স ওটির বাইরে এসে গম্ভীর মুখে পুত্রসন্তান হওয়ার খবর দিলেন। সাতমাসের বাচ্চার চোখমুখ ঠিকমতো ফুটেনি, মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে এখনো কাঁদেনি। ইনকিউবেটরে রাখা হলো বাবুটাকে। বাচ্চাটা বাঁচবে যাবে কি না, ডাক্তার সে স¤পর্কে কিছুই বলতে পারছে না। ভেতরে ভাবির স্যালাইন চলছে। বাইরে আম্মা, আমি, ভাইয়ার শ্বশুর, শাশুড়ি দুপুর থেকে ঠাঁয় বসে আছি। ভাবির আম্মা আর আমার আম্মা সমানে দোয়া ইউনূস পড়ছে বিড়বিড় করে। ভাইয়া এসে পৌছেছে আধঘন্টা আগে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে এসে অস্থির হয়ে কেবিনের সামনের কড়িডোরে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ভাইয়া আমার পাশের চেয়ারে এসে বসল। আমি আমার প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ওর ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করি, ভাইয়ার বুকের ভেতরটা কি কখনও অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হয়?
জবার মৃত্যুর পর হঠাৎই এই প্রথম ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলে ফেললাম ‘ভাইয়া তোর কি জবার কথা মনে পড়ে?’ আচমকা এ প্রশ্নে ভাইয়ার সপ্রতিভ সুন্দর মুখটা দপ করে নিভে গেল। ভাইয়ার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আমি চোখদুটো বন্ধ করলাম। জবার মুখটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সামনে , ভাইয়ার মুখের দিকে বিষণœ চোখে তাকিয়ে যেন হাসছে জবা । দু’হাতে মুখ ঢেকে আমি মনে মনে প্রার্থনা করি, ‘জবা, যদি পারিস, ক্ষমা করে দিস…

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 Mirzapurpratidin এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ভিডিও বা ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি
Site Customized By NewsTech.Com