মো. জোবায়ের হোসেন
জন্ম নিবন্ধন কিংবা জাতীয় পরিচয় পত্র এখন আবশ্যিক দলিল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কয়েকবছর আগেও বিভিন্ন কাজে এগুলোর তেমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিলোনা। কিন্তু এখন বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয় পত্রে থাকা নামের ভুল, জন্ম তারিখের ভুল, পিতা-মাতার নামে ভুল ইত্যাদি ভুলে অসম্ভবরকম বিড়ম্বণায় পড়েছেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার হাজার হাজার মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অদক্ষ জনবল দিয়ে তথ্য সগ্রহ, ডাটা এন্ট্রিকারীদের গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতাসহ আরও বেশকিছু কারণে এমন বিড়ম্বণায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। তবে এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের অসচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী। ফলশ্রুতিতে ভুল সংশোধন করতে গিয়ে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের অর্থের অপচয় হচ্ছে অপরদিকে এসবের সমাধান করতে গিয়ে দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে অনেক সময়ও ব্যয় হচ্ছে। আর এসব ঘিরে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০ জন মানুষ জন্ম তারিখ, নামের বানান ইত্যাদি সমস্যা দিয়ে তাদের অফিসে যান। ভুলের ধরন অনুযায়ী কিছু সমস্যার সমাধান উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে হয় আবার কিছু ভুলের জন্য জেলা নির্বাচন কমিশন অফিস এমনকি আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসও পর্যন্ত যেতে হয়।

মির্জাপুর পৌরসভার পুষ্টকামুরী পূর্বপাড়া গ্রামের জাকিয়ার হোসেন বলেন, জাতীয় পরিচয় পত্র করার সময় ডাটা এন্ট্রিকারির কাছে আমি আমার এসএসসি পাসের সনদ জমা দিলেও আমার জাতীয় পরিচয় পত্রে নামের বানান ভুল এসেছে। এখন নিজের টাকা খরচ করে সেই ভুল সংশোধন করতে হচ্ছে।
উপজেলার ভাতগ্রাম ইউনিয়নের কুইচতারা গ্রামের শহীদুর রহমান বলেন, প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিচয় পত্র পেয়েছেন তিনি কিন্তু সেখানে জন্ম তারিখ ভুল লেখা হয়েছে। অথচ তার জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্টে জন্ম তারিখ ঠিক রয়েছে।
লতিফপুর ইউনিয়নের গেড়াকী গ্রামের খোয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার মেয়ে এইবার প্রথম আইডি কার্ড পাইছে। কিন্তু আইডি কার্ডে আমার নাম ভুল লিখছে। ভুল ইউনিয়ন পরিষদ থিকাই করছে। এহন জরিমানা আমার। এইগুলা ঠিক করতে কত কিছু লাগতাছে। গরীব মানুষগো খালি বিপদ আর বিপদ।’
এছাড়াও জীবিত ব্যক্তিতে জাতীয় পরিচয় পত্রের সার্ভারে মৃত হিসেবে তালিকাভুক্ত করার ফলেও ঘটছে মহাবিপত্তি। জীবিত ব্যক্তিকে মৃত হিসেবে তালিকভুক্ত করায় ভাতা বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অনুপযুক্ত বিবেচিত হচ্ছেন করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণে আগ্রহীরা।
এমন ঘটনা ঘটেছে উপজেলার তরফপুর ইউনিয়নের তরফপুর গ্রামের ভাতাভোগী ৮৪ বছরের বৃদ্ধা আয়শার বেলায়। এতোদিন জাতীয় পরিচয় পত্রের সার্ভারে তিনি মৃত হিসেবে তালিকাভ্ক্তু হয়েছিলেন তা জানা ছিলনা তাঁর। কিন্তু ভাতা প্রদান কার্যক্রম আধুনিকায়ন হওয়ার পর তিনি তাকে মৃত হিসেবে জানতে পারেন। প্রায় বছর খানেক অপেক্ষার পর সম্প্রতি তিনি জীবিত হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছেন। তবে ভাতাভোগীর তালিকা থেকে তিনি এতোদিন বাদ পড়েছিলেন ফলে বছর খানেক সময়ের ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, যদি এভাবে কেউ ভাতাভোগীর তালিকা থেকে বাদ পড়ে থাকেন তবে ভুল সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তিনি ভাতা পাবেন না। কিন্তু সংশোধনের পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাকে বা তাদের পুনরায় ভাতাভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে তিনি জানান।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শরিফা বেগম বলেন, তথ্য সগ্রহকারীদের ভুল ও ডাটা এট্রি করার সময় করণিক ভুলের কারণে এধরনের সমস্যা হয়েছে। তবে উপযুক্ত দালিলিক প্রমাণ দিলে এখন স্বল্প সময়ের মধ্যেই এগুলোর সমাধান হচ্ছে।
অপরদিকে, উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন তথ্যসেবা কেন্দ্রে গড়ে মোট ২ থেকে ৩ শতাধিক মানুষ জন্ম নিবন্ধনের ভুল জনিত সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। বর্তমানে ভুক্তভোগীর গড় সংখ্যা এই পর্যায়ে থাকলেও মাস খানেক আগে এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা কয়েকগুন বেশী ছিল এবং ডিসেম্বরে এই সংখ্যা আবারও বাড়ার আশংকা রয়েছে।
পৌর এলাকার মো. মজনু নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘তার দুই ছেলের জন্ম নিবন্ধনে বাবার নামের জায়গায় দুটিতেই ভুল লেখা হয়েছে এবং ভুল দুটিও দুই রকম। বিষয়টি আগে খেয়াল না করায় তাঁর দুই ছেলের স্কুল সার্টিফিকেটেও ভুল হয়েছে। যা নিয়ে এখন সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।’ কিভাবে এর সমাধান মিলবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তিনি।
একই ধরনের সমস্যার কথা জানিয়ে উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম নিবন্ধনে বাবা-মায়ের নাম একেকটায় একেক রকম লেখা হয়েছে। এছাড়া সেগুলোর সাথে তাঁর জাতীয় পরিচয় পত্রে থাকা তথ্যেরও গড়মিল রয়েছে। সবকিছুর জন্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন তিনি।
এদিকে জন্ম নিবন্ধন জনিত জটিলতার কারনে জাতীয় পরিচয় পত্র করতে পারছেন না উপজেলার তরফপুর ইউনিয়নের তরফপুর ভূইয়াপাড়া গ্রামের আফসার উদ্দিন। তিনি বলেন, দুবাই প্রবাসে থাকাকালীন সময় সেখানে জন্ম নিবন্ধন করেন তিনি। কিন্তু জন্ম নিবন্ধনে তার নামের বানান ইংরেজীতে ঠিক থাকলেও বাংলায় ভুল লিপিবদ্ধ হয়েছে। দেশে আসার পর ওই ভুল সংশোধন করতে ইউনিয়ন পরিষদে গেলে ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র থেকে তাকে ভুল সংশোধনের জন্য দুবাই যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ সচিবদের সাথে কথা বলে তাদের যে ভাষ্য পাওয়া গেছে তা হলো- অনেক তথ্য সংগ্রহকারী এক বাড়িতে বসে দশ বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করেছেন। যেখানে অহরহ ভুল হয়েছে। আর সেই ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা তথ্য নথিভুক্ত করেছেন। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানোর সময় অভিভাবকরা ইচ্ছাকৃতভাবে বাচ্চাদের বয়স কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে বর্তমান সময়ে এসে তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, সরকার নির্ধারিত ফি’র মাধ্যমে নিবন্ধন অথবা সংশোধনের আবেদন গ্রহণ করে তা নিষ্পত্তি করা হয়। এক্ষেত্রে হয়রানি অথবা অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুযোগ নেই। তারপরও কেউ এ ব্যাপারে অভিযোগ দিলে তাৎক্ষণিক আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
Your article helped me a lot, is there any more related content? Thanks!